মো. রাশিদুল ইসলাম, গুরুদাসপুর (নাটোর) সংবাদদাতানাম আছে। অস্তিত্ব নেই। কোথাও সরু খাল। কোথাও কাঁচা পাকা স্থাপনা। কোথাও আবার খনন করা হয়েছে অবৈধ পুকুর। সব মিলিয়ে পানি প্রবাহের কোন ব্যবস্থা নেই। পম পাথুরিয়া থেকে বিলকাঠোর। দীর্ঘ ১৭ কিলোমিটারের এই এলাকাজুড়ে এমন পরিস্থিতি। গুরুদাসপুরের তুলশীগঙ্গা ও মির্জা মামুদ নামের দুটি নদীর বর্তমান অবস্থা এটি। নদী দুটি কেবল মানচিত্র সর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
৮০ দশকের শেষের দিকেও এই নদী দুটি ছিল খরস্রোতা। বছর জুড়েই ছোট বড় নৌকা চলাচল করতো। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিতে কৃষকরা অন্তত ১৫টি বিলে নির্বিঘ্নে চাষাবাদ করতেন। জেলেরা উন্মুক্ত জলরাশিতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নদী দখল হয়েছে। প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে স্থাপনা, দোকান পাট নির্মাণ করেছেন। খনন করা হয়েছে অনেক পুকুরও। মরা নদীতে আর পানি প্রবেশ করে না। বরং বর্ষায় সৃষ্ট পানি নিস্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতায় হচ্ছে ফসলহানি।
গুরুদাসপুর ভূমি অফিসের তথ্যে জানা গেছে—উপজেলা চাপিলা ইউনিয়নের পম পাথুরিয়া থেকে শুরু হয়ে খামারপাথুরিয়া, নওপাড়া, তেলটুপি, পুঠিমারি হয়ে রওসনপুর নাজিরপুরের বৃকাশো মৌজায় এসে মির্জামামুদ নদীতে মিলিত হয় তুলশিগঙ্গা নদী। সেখান থেকে ধারাবারিষার সন্তোষপুর, বিন্যাবাড়ি, নারিবাড়ি দক্ষিণ পাড়া, পাঁচশিশা, চলনালী, চরকাদহ, মশিন্দার হাঁসমারি, দরি হাঁসমারি, বামনগাঁড়া, কাছিকাটা হয়ে বিলকাঠোর এস আত্রাই গুমানী নদীতে এসে তুলশিগঙ্গা নদী মিলিত হয়। সিএস নকশায় এমন দেখা গেলেও নদী দুটির ব্যস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।
চলনবিলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত প্রায় ১৬টি নদী এখন মৃতপ্রায়। বর্ষায় আত্রাই, গুমানি, নন্দকুঁজা নদীতে কোনমতে পানি প্রবাহ থাকে। বাস্তবতায় এসব নদীরও পাড় ঘেঁষে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে।
নদীপাড়ের বাশিন্দারা জানান, নদী খেকোদের প্রভাব, দখল-দুষণ আর ভরাটের কবলে পড়ে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, বড়ালসহ চলনবিলের প্রধান ১৬ টি নদ-নদী অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে রয়েছে—আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ইত্যাদি। ১৮টি খালের মধ্যে আছে—নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর।
বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও মিজানুর রহমান জানান—৮০-র দশকে নদীর উত্স মুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে পুকুরে পরিনত হয়েছে। এ ছাড়া চলনবিলের প্রধান নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা ও গুমানীসহ ১৬ টি নদ- নদীতে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
নাটোর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘গঙ্গা ব্যারেজের কারণে উজানে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বড়ালের নাব্য কমে গেছে। এটি একটি জাতীয় সমস্যা। তবে অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চলমান আছে।’
পানিশূন্য তিস্তা!
গঙ্গাচড়া (রংপুর) সংবাদদাতা জানান—নাব্য হারিয়েছে তিস্তাসহ রংপুর অঞ্চলের প্রায় ৫০টি নদী। হারিয়ে ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার ডালিয়া ও দোয়ানীতে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলে কৃষি জমিতে যে সেচ দেওয়ার কথা, তাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পরিবেশগত ও নৌ-যোগাযোগ ক্ষেত্রে। দেখা দিয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়। প্রকৃতি ক্রমাগত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। ফলে এই তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে পানির স্তর নিম্নমুখী হচ্ছে।
উত্তরের প্রাচীনতম জনপদ রংপুর অঞ্চলে তিস্তা, ইছামতী, ধরলা, করতোয়া, দুধকুমার, জলঢাকা, সতী ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানাস, কুমলাই, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরী, হলহলিয়া, লহিতা, ঘরঘরিয়া, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাঁটখালী, সারমারা, রায়ঢাক, যমুনেশ্বরী, চিতনী, মরা করতোয়া, আলাই, ঘাঘট, কুমারীসহ প্রায় ৫০টি নদী এখন মৃতপ্রায়। এসব নদীর নাব্য নেই, কোনো কোনো নদীতে হাঁটুজল। বাংলাদেশের ১১২ মাইল দীর্ঘ তিস্তা শুকিয়ে গেছে।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদীগুলো পুনরুদ্ধার করতে হলে অবৈধ বাঁধ অপসারণ, নদীর তলদেশ খনন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে উত্সমুখ উন্মোচন করতে হবে। কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে ছোট নদীগুলোর সঙ্গে বড় নদীর সংযোগ স্থাপন করা গেলে কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলের নদীগুলোতে আবার যৌবনে ফিরবে।’
পদ্মা বাঁচানোর দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধন
রাজশাহী অফিস ‘পদ্মা নদী বাঁচলে, রাজশাহী বাঁচবে’ স্লোগানে বুধবার রাজশাহীতে মানববন্ধন করেছে সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। বেলা ১১ টায় রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে যৌথভাবে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে পদ্মায় পানির প্রবাহ বাধামুক্ত, রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে নদী তদারকি ও প্রতি জেলায় কমিশনের ইউনিটের দাবি জানানো হয়। বাপা রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি মো. জামাত খানের সভাপতিত্বে মানববন্ধন থেকে অবিলম্বে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা দখলমুক্ত ও নদী ড্রেজিং এবং প্রস্তাবিত উত্তর রাজশাহী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে পরিবেশ দুষণমুক্ত করারও দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান রবু মিয়া, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান প্রমুখ বক্তৃতা করেন।