মোঃ রাশিদুল ইসলাম, গুরুদাসপুর (নাটোর) সংবাদদাতাঃ বনজঙ্গল ঘুরে শিয়াল-বেজি, খরগোস-কচ্ছপসহ নানান বন্যপ্রাণী নিধন করেই চলতো তাদের জীবিকা। সময়ের ব্যবধানে বন-বাদার উজাড় হয়েছে। বন্ধ হয়েছে জীবিকার সেই পথ। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বেছে নিয়েছে কৃষি কাজ। বর্ষায় ডুবে যাওয়া চলনবিলে সেই কৃষি কাজও এখন নেই বললেই চলে।
যা আছে তা চাহিদা মেটানো হচ্ছে স্থানীয় শ্রমিক দিয়েই। এতে চলনবিলে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা কাজ পাচ্ছে না। ফলে চলছে না তাদের সংসার। তাই কষ্টে-অনাহারে-অর্ধাহারে-অপুষ্টিতে ভুগছে তারা। জীবন বাঁচাতে অনেকেই আবার মহাজনী ঋণ ও আগাম শ্রমবিক্রি করছেন। কেউ কেউ ঝাড়ু-খেজুর পাতার পাটি বিক্রি করছেন। কিছু সংখ্যক মহিলা উঁচু এলাকায় গিয়ে সীমিত মজুরিতে কাজ করছেন। তাতেও সংসার চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। এভাবে কষ্টে জীবন যাপন করছেন প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ।
ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নেতাদের দাবি, বর্ষাকালীন সময়ে অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতার সুবিধা প্রদানসহ বিশেষ কর্মসূচির আওতায় এনে পুনর্বাসন করা। অন্যথায় এসব জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো অভাব মেটাতে নানারকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে।
আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলনবিলের গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ, রায়গঞ্জ উপজেলা এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এদের মধ্যে উড়াও, মাহাতো, রাজবংশী, বিদাস, কনকদাস ও স্বল্প সংখ্যক সাঁওতাল ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নারী-পুরুষ রয়েছে। এক সময় এসব সমপ্রদায়ের নারী-পুরুষ বনজঙ্গলে ঘুরে শিয়াল, খরগোস, বেজি, কচ্ছপসহ নানা ধরনের প্রাণী নিধন করে জীবিকা নির্বাহ করতো। সময়ের ব্যবধানে বন-বাদার উজাড় হয়ে পড়ায় তাদের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে পড়ে।
পরে সংসার চালাতে জীবিকা হিসেবে তারা ধান লাগানো, কাটা, মাড়াই, ইটভাটায় শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ বেছে নেয়। কঠোর পরিশ্রমী, সহজ-সরল আর অপেক্ষাকৃত কমদামে শ্রমিক পাওয়ায় এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের চাহিদা অনেক বেশি।
হেমন্ত ও শরতে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের এলাকায় কাজ থাকে না। এ সময় মাঠে পাকা ধান কিংবা ইটভাটায় ইট তৈরির কাজ এবং কৃষকের বাড়িতে শ্রমিকের কাজ থাকে না। এ অঞ্চলের ৮০-৮৫ ভাগ ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী কৃষি শ্রমজীবী। কৃষি শ্রম বিক্রি করেই তাদের সংসার পরিচালনা করতে হয়। কাজ না থাকায় অর্থ সংকটে পড়ে বর্তমানে তারা আগাম শ্রম বিক্রি শুরু করেছেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে চলনবিলে গিয়ে দেখা যায়, ৫/৬ জন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী মহিলা চলনবিলের মাঠঘাট থেকে বিন্নার ফুলকা, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন গাছ থেকে খেজুরের পাতা সংগ্রহ করছেন। ওই দলের অনিমা উড়াও ও রুপালী কেরকাটা জানান, তাদের বাড়ি তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর গ্রামে। তাদের কাজ না থাকায় জীবিকা হিসেবে এগুলো সংগ্রহ করছে। বাড়িতে নিয়ে ঝাড়ু ও খেজুর পাতার পাটি তৈরি করে বিক্রির পর চালসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনবেন।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, গুরুদাসপুরের ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নারীরা উঁচু এলাকায় গিয়ে সীমিত মজুরিতে ধান রোপণের কাজ করছেন। সেখানে কর্মরত শ্যামলী রানী ও কুমারী আল্পনা রানী জানান, সকাল থেকে ৪টা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে তারা মজুরি পাচ্ছেন ১৫০ থেকে ২শ টাকা। তাতে কোনো রকমে বেঁচে রয়েছেন। গুরুদাসপুরের চাপিলা গ্রামের কৃষক বদরউদ্দিন জানান, কাজ না থাকায় শ্রমজীবী ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের নিকট থেকে সহজ শর্তে তিনি আগাম শ্রম কিনেছেন।
আদিবাসী ফাউন্ডেশনের (তাড়াশ) সভাপতি বলেন, তাড়াশ এডিপি ওয়ার্ল্ড ভিশন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে হাঁস-মুরগি, ছাগল, গাভী পালন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ পরিবারের আয়মূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুদান ও ঋণ প্রদান করত। কিন্তু গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে এনজিও নির্ভর সহযোগিতা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর নর-নারীদের আগাম শ্রম বিক্রির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নাটোর জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সভাপতি রমানাথ মাহাতো বলেন, গুরুদাসপুর ও সিংড়া উপজেলা এলাকার আদিবাসীদের ঘরে ঘরে অভাব চলছে। গুরুদাসপুরের চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন ভুট্টু বলেন, গুরুদাসপুরে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের ভিজিডি ভিজিএফয়ের আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে।
0 comments: