জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলনবিল ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময়েই চলনবিলের সৃষ্টি। গঠিত হওয়ার সময় চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার। বর্তমানে এর আয়তন অনেক কমে এসেছে।
আসলে চলনবিল অনেকগুলো ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষায় এই বিলগুলোতে জলপ্রবাহ বেড়ে একসঙ্গে বিশাল এক বিলের সৃষ্টি হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ, পাবনা জেলার চাটমোহর এবং নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা জুড়ে এ বিলের বিস্তৃতি।
বিলের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত পাবনা জেলার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা পর্যন্ত বিস্তৃত। এর প্রশস্ততম দিকটি উত্তর-পূর্ব কোনাকুনি। নাটোরের সিংড়া থেকে গুমনী পাড়ের কচিকাটা পর্যন্ত এ বিলের সবচেয়ে বড় অংশ, যা প্রায় চব্বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ। নাটোরের সিংড়ার পূর্বপ্রান্ত থেকে পাবনার তাড়াশ উপজেলার ভদাই নদীর পূর্ব পাড় পর্যন্ত বিলের পূর্ব সীমানা।
চলনবিলের সবচেয়ে বড় অংশ পড়েছে নাটোরে। জেলার সিংড়া উপজেলায় রয়েছে চলনবিলের বড় একটি অংশ। এছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়ুল থেকে বনপাড়া পর্যন্ত দীর্ঘ সড়ক তৈরি হয়েছে চলনবিলের বুকেই।
সড়কের দুপাশে এ সময়ে যেদিকে চোখ যায় শুধু অথৈ জলরাশি। এ পথে চলতে চলতে সড়কের দুপাশে চলনবিলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় দুচোখ ভরে। নিজস্ব গাড়িতে গেলে ইচ্ছামতো থেমে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব। এছাড়া চলনবিলের আকর্ষণীয় একটি বিল ‘হাইতি বিল’। এটি নলডাঙ্গা উপজেলায়। জেলা শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এ বিলের অবস্থান।
হাইতিকে দেশের সবচেয়ে গভীর বিল বলা হয়। প্রায় ১২ মিটার গভীর এই বিলে সারাবছরই পানি থাকে। বর্ষায় পানির পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক বেশি।
যাতায়াত ও থাকা : ঢাকার গাবতলি থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, ন্যাশনাল পরিবহন প্রভৃতি বাসে নাটোর যাওয়া যায়। এছাড়া রাজশাহীগামী যে কোনো বাসেই নাটোর আসা সম্ভব। ভাড়া ৩শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা। নাটোরের চলনবিল দেখতে গেলে থাকতে হবে নাটোর জেলা সদরে। শহরে থাকার জন্য আছে চকরামপুরে হোটেল ও ভিআইপি হোটেল এবং মাদ্রাসা রোডের হোটেল উত্তরা ও হোটেল মিল্লাত। ভাড়া ২শ’ টাকা থেকে ৬শ’ টাকা।
জেলার রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে চলনবিলের অংশ বিশেষ। চলনবিলের বেশ কয়েকটি বিল পড়েছে এ দুই উপজেলায়। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়ুল মোড় থেকে বনপাড়া সড়কে প্রবেশ করলে কিছু দূর যাওয়ার পর চলনবিলের যে অংশের দেখা মিলবে সেটাও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মধ্যে। এখান থেকে দক্ষিণ দিকের পুরো অংশটাই এই জেলার অন্তর্গত চলনবিল।
যাতায়াত ও থাকা : ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ আসা যায় সড়ক ও রেলপথে। ঢাকার মহাখালী থেকে সৌরভ পরিবহন, এসআই এন্টারপ্রাইজ এবং গাবতলী থেকে ইউনিক সার্ভিসসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস যায় সিরাজগঞ্জ। ভাড়া ২শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা। সিরাজগঞ্জ থেকে রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলায় আসা যাবে লোকাল বাসে। সিরাজগঞ্জ শহরে থাকার জন্য ভালো মানের হোটেল হল-- আল হামরা। ভাড়া ৩৫০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা। নিজস্ব বাহনে গেলে দিনে দিনেই ঢাকা থেকে গিয়ে ঘুরে আসা যায়।
চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চলনবিলের অংশ। গাজনা, বড়, সোনাপাতিলা, ঘুঘুদহ, চিরল, গুরকা ইত্যাদি বড় আকারের বিলগুলো বেশিরভাগই পাবনা জেলায়। বড়বিলের আয়তন প্রায় ৩১ বর্গ কিলোমিটার ও সোনাপাতিলা বিলের আয়তন প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার। এছাড়া এ বিলের আরও দুটি বৃহৎ অংশ যথাক্রমে ১৮ ও ১৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের কুরলিয়া ও দিক্ষি বিল চাটমোহরে অবস্থিত। বর্ষায় এ বিল থাকে জলে পরিপূর্ণ। জেলা সদর থেকে বাসে চাটমোহর এসে সেখান থেকে রিকশায় আসা যায় চলনবিলে।
যাতায়াত ও থাকা : ঢাকা থেকে সরাসরি পাবনা যাওয়া যায় সড়কপথে। প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্থার বাস চলাচল করে এ পথে। পাবনা এক্সপ্রেস, শ্যামলী পরিবহন, রাজা বাদশা পরিবহন, কিংস পরিবহন, বাদল গ্র্যান্ড চয়েজ, সরকার ট্রাভেলস ইত্যাদি। ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। পাবানা শহরে থাকার জন্য সাধারণ মানের হোটেল হল-- জালালপুরে প্রশান্তি ভুবন পার্ক, হোটেল পার্ক, হোটেল শিল্টন ইত্যাদি। ভাড়া ৫শ’-১৫শ’ টাকা।
চলনবিলে বেড়ানোর জন্য স্থানীয় নৌকা পাওয়া যাবে ভাড়ায়। সারাদিনের জন্য ভালো মানের একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ৫শ’ টাকা থেকে ৬শ’ টাকা। এছাড়া ইঞ্জিন নৌকা মিলবে ১ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার টাকায়। সাঁতার না জানলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেবেন। নৌকায় ভ্রমণকালে হৈচৈ, লাফালাফি করবেন না।
এই সুযোগে দেখে নিতে পারেন চলনবিল জাদুঘরটিও। গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজিপুর গ্রামে এ জাদুঘর। স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হামিদ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় নিজ বাড়িতে ১৯৭৮ সালে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমী এ সংগ্রশালা। চলনবিলে প্রাপ্ত নানান নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম ছাড়াও এখানে আছে অনেক দুর্লভ সংগ্রহ। নাটোর থেকে বাসে গুরুদাসপুর উপজেলায় এসে সেখান থেকে নদী পার হয়ে রিকশায় আসা যাবে খুবজিপুর গ্রামের এই জাদুঘরে।