বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনকে ছাত্রলীগের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সম্মেলন হিসেবে দেখেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেননা,এ সম্মেলনে নেতৃত্ব যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সরাসরি তত্ত্বাবধান করেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত মে মাসের ১১ ও ১২ তারিখ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন হলেও সাথে সাথে ঘোষণা করা হয়নি ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব। প্রায় আড়াই মাস যাবত বিভিন্ন মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে গত ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এ কমিটিতে সভাপতি হিসেবে মো. রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গোলাম রাব্বানী দায়িত্ব পেয়েছেন।
ছাত্রলীগের নবনিযুক্ত সভাপতি মো. রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া তিনি ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী পরিবারের সন্তান। ছাত্রলীগের মতো দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্বদাতা এমন বৃহৎ সংগঠনের নেতৃত্ব পাওয়ার পরও নিজেকে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন শোভন। সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত এই ছাত্রনেতা দায়িত্ব পাওয়ার পরও থাকছেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলে। ছাত্রলীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সুন্দর আচরণের জন্যও ভূয়সী প্রশংসায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি।
ছাত্রলীগের এই নতুন প্রধান ছাত্ররাজনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিবার্তা অনলাইনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মহিউদ্দিন রাসেলের সঙ্গে কথা বলেছেন একান্ত আলাপচারিতায়।
বিবার্তা : ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদিত কমিটিতে আপনি সংগঠনটির সভাপতি হয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি বলুন।
শোভন : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসায় প্রচলিত অর্থে আনন্দের কিছু নেই। এটা আসলে দায়িত্ব পালনের বিষয়।
বিবার্তা : আপনি ছাত্রলীগের পূর্বের ও বর্তমান কমিটির মাঝে কী পার্থক্য দেখেন?
শোভন : পূর্বের ও বর্তমান ছাত্রলীগের নীতিগত কোনো পার্থক্য নাই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি। যারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তারাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে গেছেন। তবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
বিবার্তা : সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?
শোভন : আমরা ছাত্র, আমাদের ছাত্রদের মতো আচরণ করতে হবে। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। কোনো গ্রুপিং না করে দেশরত্ন শেখ হাসিনার নির্দেশ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে চালিকাশক্তি হিসেবে ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীকে কাজ করতে হবে।
বিবার্তা : আগামী কতদিনের মধ্যে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেয়া হবে এবং তা কত সদস্যবিশিষ্ট হবে?
শোভন : এটা আলোচনার বিষয়। কমিটি কত সদস্যবিশিষ্ট হবে তা আমার একার সিদ্ধান্তে র কিছু নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিবার্তা : কমিটি প্রণয়নে গঠনতন্ত্র অনুসরণ করা হবে না?
শোভন : ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি হওয়ার কথা ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট। পরে বর্ধিত সভা ডেকে করা হয়েছে ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট। আমরা বিবেচনা করব কতজনের কমিটি দেয়া যায়। সামনে নির্বাচন, আমাদের হল কমিটিগুলো আছে। আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে।
বিবার্তা : কমিটিতে কারা মূল্যায়িত হবে?
শোভন : যারা কেবল মুখের কথায় না, বরং কাজে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এবং নম্র, ভদ্র, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন কর্মী, তাদেরই মূল্যায়ন করা হবে। আমাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে না। সংকটময় পরিস্থিতি বা সে রকম কোনো বিষয় নয়। আমাদের দেখে যেন মানুষ শেখে, এ রকম ছেলেদের কমিটিতে আনতে পারি।
বিবার্তা : ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আপনারা কি ধরনের পদক্ষেপ নিবেন?
শোভন : অনুপ্রবেশকারী বলতে কাকে বুঝছি তা আগে বুঝতে হবে। অনুপ্রবেশকারী বলতে আমি বুঝি যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নাই কিন্তু তারা ছাত্রলীগ করছে, এরাই তো অনুপ্রবেশকারী। আমরা অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করব, যারা ২০১৪ সালের প্রেক্ষাপটে মাঠে ছিল, আমরা সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি বানানোর চেষ্টা করব। কেন্দ্রীয় কমিটি এমন কমিটি যেখানে উড়ে এসে জুড়ে বসবে এ রকম না। কোথাও না কোথাও অবদান আছে, ছাত্রলীগের কোন ইউনিটে কাজ করেছে, কোন জেলায় কাজ করছে। সেখানে একটা ভাইটাল রোল প্লে করেছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বিচার করব।
বিবার্তা : সামনে ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন শুরু হয়েছে। নির্বাচনে ছাত্রলীগ কী ভূমিকা নেবে?
শোভন : এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয় যদি নির্বাচন দেয়, আমরা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করব। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করে অংশ নিবে।
বিবার্তা : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে ঢাবির টিএসসিতে এক প্রোগ্রামে বলেছেন, ছাত্রলীগ নিরক্ষরতা দূরীকরণে কাজ করবে। ছাত্রলীগ এ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সেগুলোর অগ্রগতি কতদূর?
শোভন : আপনারা জানেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬%, ১৯৭৪ সালে ছিল ২৫%, আর আজকে বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭২%, তো এর একটা অগ্রগতি হয়েছে। আরও ২৮% আছে তো। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সামনে নির্বাচন, এই সময়টাতে আমরা যেটা করতে পারি, প্রত্যেকটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্রলীগের যারা কর্মী আছে, একজন একজন করে সাক্ষরতা শেখাবে। এটা আমরা চেষ্টা করছি। এটা বলে দেয়া হয়েছে। তারা নীরবেই কাজ করছে। পরবর্তীকালে সার্ভে করলে দেখবেন ১০০% হয়ে গেছে।
বিবার্তা : পূর্বের কমিটিগুলোতে টাকা নিয়ে পদ দেয়ার অভিযোগ ছিল। আপনাদের কমিটিতে এরকম কিছু থাকবে কিনা?
শোভন : আমরা যে জেলায় কমিটি দেব, আমরা দেশরত্নের সাথে কথা বলেই কমিটি দেব। তিনি দুজনকে সিলেক্ট করে দেবেন। তার দ্বারা সব করা তো সম্ভব না। আবার মনে করেন ওই এলাকায় ছয়টা ছেলের নাম লিস্ট করলাম যারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। আমরা ছয়টা ছেলের কথা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বলব যে তারা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। এরপর প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজস্ব মাধ্যমে তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে সিলেকশন দেবেন। আমরা ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি হয়েছি। সব কিছুই দেশরত্ন শেখ হাসিনা করবেন, আমরা শুধু তাকে মেসেজ জানাবো যে এখানে এটা হচ্ছে, কোনটা করব। আমরা সিদ্ধান্ত নেব না।
বিবার্তা : এক্ষেত্রে কি তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হবে?
শোভন : অবশ্যই, আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। আমার হাত দিয়ে কেউ পদে বসবে, অথচ সে আওয়ামী লীগ পরিবারের ছেলে নয়, এরকম হবে না।
বিবার্তা : দলে এমন নেতা আছে যারা ফেসবুকে আপনাদের ট্যাগ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ; মাঠে ময়দানে নেই। এরা ভালো ফোকাসেও চলে আসে। আর এদের অতিমাত্রায় ফোকাসের কারণে অনেক সময় মাঠের ত্যাগীরা নজরে আসে না। এ ব্যাপারে আপনাদের পদক্ষেপ কি?
শোভন : বর্তমান সাইবার ওয়ার্ল্ড একটা পৃথিবী হয়ে গেছে। তবে আমরা ফেসবুক ট্যাগীদের নয়, মাঠের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করবো। কে সংগঠনের জন্য কি করছে সে ব্যাপারে আমরা ভালোই খোঁজখবর রাখছি। সংগঠনের যে মূল বেইজ, সেখানে থাকতে চাইলে তাহলে অবশ্যই মাঠে পরীক্ষিত হতে হবে।
বিবার্তা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অনেক বহিরাগত থাকে। তারা ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে হলে থাকছে। এমনকি আপনার হল মুহসিন হলেও আছে।
শোভন : আমি হলের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারির সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেব। আমি এসএম হলে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রভোস্ট স্যারের সাথে কথা বলে আসছি। হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। আমি বলেছি, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, তাদের বের করে দিন।
বিবার্তা : গুজব নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আপনারা গুজবের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
শোভন : আসলে বাঙালিরা একটু অন্যরকম। আমাদের তরুণ সমাজ পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন। এ কারণে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেশি হচ্ছে। আমরা এতটাই সেলফিপ্রবণ হয়ে গেছি যে আমাদের যে মূল্যবোধ তা না ধারণ করেই আমরা ফেসবুকে লাইক পড়বে সে জন্য গতানুগতিক গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে ওই দিকেই দৌড় দেই। আমাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ, মূল্যবোধ তৈরি করতে হবে।
বিবার্তা : কেমন বাংলাদেশ চান?
শোভন : আমি এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে সবাই হাসবে। আমি এখনো বাড়িতে গেলে চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়াই। তাদের কিন্তু খুব বেশি চাওয়া-পাওয়া নাই। আমরা যখন তাদের সাথে কথা বলি তারা যে হাসে, তাদের হাসিটা যে পবিত্র, তা যেন তারা সত্যিকার হাসতে পারে, সেই বাংলাদেশ চাই।