বিলের পর বিল রসুনের আবাদ। এ মওসুমেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। অন্তত সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে এই আবাদ হয়েছে। কেবল উৎপাদন আর দামেই দেখা দিয়েছে সংকট। বিঘায় উৎপাদন হয়েছে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ মণ হারে। যার বর্তমান বাজার মূল্যে মণ প্রতি ৪শ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা।
রসুনের ফলন বিপর্যয়ের এ মওসুমে দাম কম হওয়ায় রিতিমতো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষক। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষিরা। অনেক কৃষক শুধু রসুন আবাদের জন্যই চড়া মূল্যে জমি বর্গা (লিজ) নিয়ে আবাদ করেছেন। রসুুনের প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় সেসব চাষী নিঃস্ব প্রায় হয়ে পড়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, গত মওসুমেও বিঘায় রসুনের উৎপাদন ছিল ২৫/৩০ মণ হারে। কিন্তু এ মওসুমের চিত্র ভিন্ন। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ফলন অর্ধেকেরও নিচে মেনেছে। দামও সর্বনিম্ন। এতে কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বেশিরভাগ কৃষক মহাজনী ঋণসহ ব্যাংক এনজিও থেকে চড়া সুধে ঋণ নিয়ে রসুন আবাদ করেছেন। চৈত্র মাসে উৎপাদিত ওই মসলা জাতীয় ফসল কৃষকের ঘরে আসলেও ঋণ পরিশোধের তাগিদে উঠতি সময়ে কাঁচা ভেজা অবস্থাতেই তা বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে ফসলের আমদানি বাড়ায় নায্য মূল্যে থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক।
কৃষকরা জানান, কৃষি উপকরণের দাম বাড়ায়, বেড়েছে উৎপাদন খরচ। খরচের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শ্রমিকের মজুরি। কেবল বাড়েনি কৃষকের কষ্টের্জিত ফসলের মূল্য। এ মওসুমে বীজ বাবদ ৯-১০ হাজার, সার-কীটনাশক বাবদ ৫ হাজার, নিড়ানী বাবদ ২ হাজার, সেঁচ বাবদ ২ হাজার টাকা এবং রসুন উঠানো বাবদ শ্রমিক খরচ হয়েছে ৪ হাজার টাকাসহ কৃষকের সার্বিক ব্যয় হয়েছে ১৮-২৫ হাজার টাকা। এছাড়া ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষীদের একবিঘা জমিতে (বর্গা) লিজ বাবদ ১৪ হাজার টাকা বেশি ব্যায় হয়েছে। এতে প্রতি বিঘায় সার্বিক ২৫-৩৩ হাজার টাকা ব্যায়ে রসুন উৎপাদন হয়েছে ১০-২৫ মণ হারে। অধিক খরচে রসুন আবাদ করেও আশানুরূপ ফলন হয়নি। আকার ভেদে রসুনের বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি মণ ৪শ থেকে ১হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন দাম কম হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষীরা।
সরেজমিনে উপজেলার চাঁচকৈড়, নয়াবাজার ও নাজিরপুরসহ আশপাশের অন্তত দশটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, দাম কম হওয়া স্বতেও বহু কৃষক তাদের উৎপাদিত রসুন নিয়ে হাটে এসেছেন। কৃষকরা কেউ কেউ রসুন বিক্রির টাকায় শ্রমিকের মজুরি দেবেন। আবার অনেক কৃষক ঋণ পরিষদসহ প্রয়োজনের তাগিদে লোকসান মেনে নিয়েই কাঁচা ভেজা রসুন বিক্রি করছেন। কৃষকদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা কম দামে রসুন কিনে তা মজুদ করছেন। গত এক সপ্তাহে উপজেলার চাঁচকৈড়, নয়াবাজার, নাজিরপুর, কাছিকাটা, বড়াইগ্রামের মৌখারা, মানিকপুরসহ বেশ কয়েকটি হাট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এসব হাটে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকা দরে রসুন বিক্রি করেছেন কৃষক।
চাঁকৈড় হাটে কথা হয় রসুন বিক্রেতা উপজেলার যোগেন্দ্র নগর গ্রামের আব্দুল ওহাবের সাথে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, চলতি মওসুমে অধিক খরচে রসুন আবাদ করেছেন। প্রতিকুল আবহাওয়ার কারণে ফলন ভালো হয়নি। জমিতে অধিক আগাছা থাকায় রসুন উঠাতেও বেশি শ্রমিক খরচ হয়েছে। এখন শ্রমিকের মজুরি দিতেই তিনি কম দামে রসুন বিক্রি করতে এসেছেন। কৃষক মনিরুল ইসলাম, মাসুদ রানা ও প্রান্তিক চাষি আকবর আলী জানান, দাম কম জেনেও তারা হাটে রসুন বিক্রি করতে এসেছেন। ব্যাংক, এনজিও ও গ্রাম্য মহজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ১৫ হাজার টাকা বিঘা জমি বর্গা (লিজ) নিয়ে তারা রসুন আবাদ করেছিলেন। দাম কম আর ফলন বিপর্যয়ে রিতিমতো এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
ফরিয়া ব্যবসায়ী হাফিজ মুক্তার জানান, এই হাটে তিনি আকার ভেদে মণ প্রতি ৬শ থেকে ৭শ টাকায় প্রায় ৩০ মণ রসুন কিনেছেন। কুমিল্লার আব্দুল আলিম, চট্টগ্রামের ঝুনু মিয়া ও ঢাকা থেকে আসা ব্যপারি সিরাজুল ইসলাম জানালেন, তারা প্রত্যেকেই ৫০ মণ করে রসুন কিনেছেন ৬শ থেকে ১হাজার টাকায়। এতে গড়ে প্রতিমণ রসুনের ক্রয় মূল্য ৭২০ টাকা পড়েছে। এই রসুন তারা মজুত করে দাম বৃদ্ধি হলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করবেন।
চাঁচকৈড় হাটের স্থানীয় রসুন ব্যবসায়ী মেসার্স হানিফ ট্রেডার্সের স্বত্বাধীকারী মো. সায়েম ফকির ও নাছিম ভান্ডারে স্বত্বাধীকারী নাছিম আলী জানান, বছরজুড়েই তারা রসুনের ব্যবসা করেন। প্রতিহাটে তারা ১২শ মণ রসুন ক্রয় করেন। পরে সুবিধামতো সময়ে ঢাকা, সিলেট, খুলনায় বিক্রি করেন। ভরা মওসুমেও ফলন বিপর্যয়ের কারনে রসুনের দাম কম। একহাটের রসুন অন্য হাটে বিক্রি করতে গেলে দরপতনের কারনে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বিগত পাঁচ বছরে প্রতি মওসুমেই রসুন আবাদ লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়েছে। ২০১২-২০১৩ মওসুমে ১৪ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করে উৎপাদন হয় ১ লাখ ১১ হাজার ৪৩ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ মওসুমে ১৭ হাজার ৮শ ৪০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষ করে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮ মেট্রিক টন, ২০১৪-১৫ মওসমে ১৯ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩ মেট্রিক টন, ২০১৫-১৬ মওসুমে ২০ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৩ মেট্রিক টন, ২০১৬-১৭ মওসুমে ২৫ হাজার ৮শ হেক্টর জমিতে রসুনের আবাদ হয়। সর্বশেষ চলতি মওসুমে নাটোরের ৭টি উপজেলায় রসুন চাষের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছিল ২৫ হাজার ৭শ ৯৫ হেক্টর। তবে লক্ষ্য মাত্রা ছাড়িয়ে ২৮ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে রসুন চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি।
চলনালী গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম (৪৫) জানান, অন্যের জমি লিজ নিয়ে ৩ বিঘা জমিতে রসুন চাষ করেছেন তিনি। প্রতি বিঘা জমিতে রসুন চাষে বীজ, সেঁচ, সার-কীটনাশক, নিড়ানীসহ রসুন উঠানো বাবদ অধিক হারে শ্রমিক খরচ হয়েছে। কিন্তু ফলন হয়েছে বিঘায় ১২/১৪ মণ হারে। দাম কম হওয়ায় উৎপাদন খরচই উঠছে না।
মারিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হাকিম জানান, তিনি ঋণের টাকায় চলতি বছরে ৪ বিঘা জমি রসুন আবাদ করেছেন। রসুনের ফলন বিপর্যয় দামেও প্রভাব ফেলছে। বাধ্য হয়ে কম দামেই কষ্টে অর্জিত ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে করে ঋণ পরিষদ করে অন্য আবাদ করাই দৃস্কর হয়ে পড়েছে। সরকারীভাবে সহযোগীতা না পেলে তারা সর্বশান্ত হয়ে যাবেন।
কৃষি বিভাগের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম ইত্তেফাককে জানান, চলতি বছরে নাটোরের ৭টি উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অধিক রসুন চাষ করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ফলন কম দেখা যাচ্ছে। বর্ষার পানি দেরিতে নামায় কৃষকের রসুন চাষে কিছুটা বিলম্ব হয়। সে সময় বৃষ্টি পাতের কারনে রসুনের ফলন বিপর্যয় ঘটেছে। তাছাতা কাঁচা ভেজা রসুন বিক্রির ফলে বর্তমান সময়ে রসুনের দাম কম যাচ্ছে। যেহেতু ফলন কম হচ্ছে। দাম না বাড়লে কৃষক মাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
0 comments: